কী হবে আজ আদালতে: অভিযোগ প্রমাণ হলে যা হতে পারে

অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সর্বোচ্চ সাজাই হবে : রাষ্ট্রপক্ষ । মামলার ভিত্তি নেই, বেকসুর খালাস পাবেন : আসামিপক্ষ

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় আজ। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ মামলায় আসামি। খালেদা-তারেক এ মামলায় আসামি হওয়ায় রায় জানতে আজ দেশের সবার চোখ থাকবে আদালতের দিকে। দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে নির্ধারিত তারিখে রায় হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও রায় ঘোষণার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। রায়কে কেন্দ্র করে বকশীবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালত এলাকায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। রায় শুনতে বেলা ১১টার মধ্যে মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হবেন বলে নিশ্চিত করেছেন তার আইনজীবী। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করবেন।

এ মামলায় সব মিলিয়ে ২৩৬ কার্যদিবস শুনানি হয়েছে। আদালতে ৩২ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এই সাক্ষীদের জেরা করার পাশাপাশি সাফাই সাক্ষীও উপস্থাপন করেছে আসামিপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষ এক কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে খালেদাসহ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছে। ১৫ কার্যদিবসে আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এর মধ্যে খালেদার পক্ষে ৯ কার্যদিবসে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন পাঁচ আইনজীবী। আসামিদের মধ্যে খালেদা জিয়া অস্থায়ী জামিনে ও অপর দুই আসামি কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ তিন আসামি পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। এ মামলায় দুবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। আর মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৫ বার উচ্চ আদালতে গেছেন খালেদার আইনজীবীরা। এ মামলায় খালেদা জিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুবার আদালত বদল করা হয়েছে। এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে দাবি করে সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, মামলাটি ভিত্তিহীন। এ মামলায় সাজা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাবেন বলেই আশা তাদের। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য দিন ঠিক রয়েছে। আমি এ মামলার আইনজীবী তাই যথাসময়েই আদালতে যাব।’ তিনি বলেন, ‘রায় কী হবে সেটি আদালত জানে। তবে আমরা যেভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছি, যুক্তি তুলে ধরেছি তাতে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে বলেই মনে করি।’ এ মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই হবে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি প্রতিটি ধার্য তারিখে আদালতে হাজির ছিলেন। শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তাই বৃহস্পতিবার রায় শুনতেও তিনি আদালতে যাবেন।’ তিনি বলেন, ‘এ মামলাটির কোনো ভিত্তি নেই। রাষ্ট্রপক্ষ কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আসামিরা এ মামলায় খালাস পাবেন বলেই আশা তার।

অভিযোগ প্রমাণ হলে যা হতে পারে : মামলাটি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইনজীবীরা বলছেন, এ মামলায় দণ্ডবিধি দুটি ধারা (১০৯ ও ৪০৯) ও দুদক আইনের ৫(২) ধারা রয়েছে। তারা বলেন, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি অর্থদণ্ডের আদেশও দিতে পারেন আদালত। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে খালেদা জিয়া এবং কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা হিসেবে অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডও হতে পারে। এ ধারায় আদালত কারাদণ্ড না দিয়ে শুধু অর্থ দণ্ডও করতে পারে। কেননা এ ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে উভয় ধারায়ই সর্বনিম্ন দণ্ড কত হবে উল্লেখ না থাকায় তা আদালতে ইচ্ছাধীন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

সাজা হলে কারাগারেই যেতে হবে : এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের সাজা হলে কারাগারে যাওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প দেখছেন না আইনজীবীরা। তারা বলেন, এক বছরের কম সাজা হলে আপিল করার শর্তে জামিনের বিধান থাকলেও এ মামলায় এক বছর সাজা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, ‘যদি এক বছরের কম সাজা হয় তবে আপিলের শর্তে তিনি তাত্ক্ষণিক জামিন চাইতে পারবেন।’ সেই জামিনের আবেদন যে আদালত রায় দেবে সেখানেই করা যাবে, নাকি কারাগারে গিয়ে করতে হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ওই আদালতেই তাত্ক্ষণিকভাবে বিবাদী তা করতে পারবেন।’ এদিকে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হলে সাজা এক বছর হওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। জামিন চাইতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে গিয়ে আপিল করতে হবে।

আপিল করতেও প্রস্তুত আসামিপক্ষ : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া খালাস পাবেন আশা করলেও সাজা হলে আপিলের জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তার আইনজীবীরা। রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাই কোর্টে আপিল করবেন তারা। সে ক্ষেত্রে যদি সাজা হয় তাহলে আপিল করতে তাদের প্রায় সাত কর্মদিবসের মতো অপেক্ষা করতে হতে পারে। সূত্র জানায়, সাধারণত কত পৃষ্ঠার রায় তার ওপর নির্ভর করে সার্টিফাইড কপি কত দ্রুত পাওয়া যাবে। যদি ২০-২৫ পৃষ্ঠার রায় হয়, তাহলে হয়তো ২ থেকে ৩ দিনেই এ মামলার কপি পেতে পাওয়া যেতে পারে। আর যদি ১০০ পৃষ্ঠার বেশি হয় তাহলে কপি পেতে সাত কর্মদিবস সময় লেগে যেতে পারে। সূত্র আরও জানায়, রায় ঘোষণার পর ওই রায় কম্পিউটার কম্পোজ করে তার ভুলত্রুটি সংশোধন করতে হয়। সম্পূর্ণ নির্ভুল হলে সার্টিফাইড কপি দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আমরা আশা করছি এ মামলায় খালেদা জিয়া খালাস পাবেন। তার পরেও যদি সাজা হয় তাহলে আমরা হাই কোর্টে আপিল করব। রায় ঘোষণার কত দিন পর আপিল করবেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা হাই কোর্টে আপিল আবেদন দায়ের করব।

মামলার আদ্যোপান্ত : ১০ বছর আগে সৌদি আরব থেকে এতিমদের জন্য আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান, সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাঈদ আহমেদ ও গিয়াস উদ্দিনকে আসামি করা হয়। তদন্তে সাঈদ আহমেদ ও গিয়াস উদ্দিনের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নতুন করে আসামি হিসেবে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতে খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। এর প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরু করেন। মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ মামলায় ২৫ বার উচ্চ আদালতে গেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। গত বছরের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষের নেওয়া ৩২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে আদালতের ২৩৬ কার্যদিবস সময় লেগেছে। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য উপস্থাপনে ব্যয় হয়েছে আদালতের ২৮ কার্যদিবস। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানি শেষ হয়। এরপর ১৯ ডিসেম্বর থেকে মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়। আদালতের ১৬ কার্যদিবসে এ যুক্তিতর্ক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তি প্রার্থনা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এরপর ২১, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর এবং ৩, ৪, ১০, ১১ ও ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা। মামলায় খালেদা জিয়া অস্থায়ী জামিনে ও অপর দুই আসামি কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ তিন আসামি পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। দুর্নীতির এ দুই মামলায় হাজির না হওয়ায় গত বছরের ৩০ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। এরও আগে গত বছরের ১২ অক্টোবর বিদেশে থাকাকালে খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। বর্তমানে তিনি অস্থায়ী জামিনে আছেন। প্রতি ধার্য তারিখেই আদালতে হাজিরা দিয়েছেন তিনি।

বিশেষ আদালতে আরও ১৫ মামলা : বকশীবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও আরও ১৫টি মামলা বিচারাধীন। এগুলোর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে রয়েছে। অন্য ১৪টি মামলা গত ৪ জানুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করে এই আদালতে স্থানান্তর করে সরকার। মামলাগুলো হলো— গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা, দারুস সালামে নাশকতার আট মামলা, যাত্রাবাড়ী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলা এবং মানহানির দুই মামলা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সর্বমোট ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে করা। দুর্নীতির এ মামলাগুলো করা হয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। এ ছাড়া বাকি মামলাগুলো পুলিশের কাজে বাধা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত ৯ বছরে করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর